টাঙ্গাইলের সখিপুরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ‘ক্ষমতাধর’ এক ব্যক্তির নাম অন্তর আহমেদ। অথচ তিনি এই অফিসের কেউ নন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স ফাহিম এন্টারপ্রাইজের’ মালিক তিনি। শোনা যায়, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি ও যোগদান অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।
অফিসের কর্মচারীরা বলছে, অন্তর আহমেদের কথায় সম্প্রতি মোট ১৫ জনকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। তার কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম ও অচ্যুদাস গুপ্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বরাবর বদলি আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে গত ১২ আগস্ট জাহিদুল ইসলামকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ও অচ্যুদাস গুপ্তকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বদলি করা হয়।
প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অফিস যখন বহিরাগতের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন সেখানে কাজ করা যায় না।’ শুধু তাই নয় অনেক সময় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও হেনস্তার শিকার হতে হয়, একবার কথা কাটাকাটির জেরে অন্তর তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলে তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি অন্তরের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তিনি।
উপসহকারী প্রকৌশলী অচ্যুদাস গুপ্ত বলেন, ‘বহিরাগতের মাধ্যমে অফিস পরিচালিত হলে সেখানে সম্মান নিয়ে কাজ করা যায় না। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনে অবৈধ অর্থের লেনদেন হয় অন্তরের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সখিপুর বিদ্যুৎ অফিসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
অন্তরের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার গুবুদিয়া নয়নপুর গ্রামে। ২০০৬ সালে তিনি সখিপুরে আসেন। অন্তর তখন ভ্যান চালাতেন এবং বিদ্যুৎ বিলের কাগজ বাসবাড়িতে পৌঁছে দিতেন। ঘুষ নিয়ে মিটিয়ে দিতেন বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের মামলা। এক পর্যায়ে টাকা নিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া শুরু করেন। অন্তর এরপর যোগ দেন রাজনীতিতে। বাগিয়ে নেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ২০২০ সালে পান বিদ্যুতের ঠিকাদারি লাইসেন্স।
এভাবে সখিপুর বিদ্যুৎ কার্যালয়কে ব্যবহার করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন অন্তর আহমেদ। গড়গোবিন্দপুরে জমি কিনে তৈরি করছেন বহুতল ভবন। কিনেছেন ২৮ লাখ টাকা দামের প্রাইভেটকার।
স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোতালেব হোসেন গুর্খা বলেন, ‘মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে তোলা সেলফি অন্তরের মূল পুঁজি। ওইসব ছবি দেখিয়ে প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন অন্তর। মালিক হয়েছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের। গড়ে তুলেছেন একটি চক্র, যাদের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ।’
গত ফেব্রুয়ারিতে সখিপুর থেকে বদলি হয়ে বগুড়া বিদ্যুৎ কার্যালয়ে গেছেন উপসহকারী প্রকৌশলী শামসুল আলম। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অন্তরের কর্মকাণ্ড বিদ্যুৎ কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের জন্য অশনিসংকেত। এটি বন্ধ না হলে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা সেখানে যাবেন না। সেবাবঞ্চিত হবে এলাকার মানুষ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বদলি হওয়া দুই কর্মচারী বলেন, ‘অন্তরের কথার বাইরে যেতে পারেন না সখিপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর তালুকদার। কারণ সখিপুরে তাঁর পদায়নে অন্তরের হাত রয়েছে।’
এলাকার ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী মো. সোহেল এক সময় অন্তরের সঙ্গে ভ্যান চালাতেন। বিদ্যুতের চোরাই তার বহনের অপরাধে কিছুদিন আগে দুই মাস জেল খাটেন তিনি। সোহেল জানান, বিদুতের চোরাই তার বিক্রির জন্য অন্তর তাঁকে একটি পিকআপভ্যান দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। পথে পুলিশ গাড়িটি জব্দ করলে গাড়ি চালক আলহাজ ও সোহেল আটক হন।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘এতিমখানা-সোনারতরী সড়কে বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটি স্থাপনে জনপ্রতি ৬ হাজার টাকা চেয়েছিলেন অন্তর। টাকা না দেয়ায় দেড় বছর ধরে সেই কাজ বন্ধ রেখেছে সে। যেখানে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ হয়নি।’
কাউন্সিলর মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এসডিএস মোড়-কমিশনার বাড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বছরখানেক আগে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কথা বলে অন্তর ৬০ হাজার টাকা নিয়েছে। তুবুও কাজ এখনও শেষ হয়নি, টাকাও দিচ্ছে না ।’ আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বাছেদ শিকদার বলেন, ‘ঠিকাদারির নামে বিদ্যুতের তার বিক্রি, দালালিসহ নানা অপকর্মের হোতা হয়ে উঠেছেন অন্তর। পরিচালনা করছেন একটি সংঘবদ্ধ চক্র।’
তবে অন্তর আহমেদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলছে, ‘দালালি নয়, ঠিকাদারি করেন তিনি।’ দলের নেতাদের সঙ্গে তোলা সেলফি দেখিয়ে কোথাও কোনো সুবিধা নেননি বলে দাবি তার। কাউকে অসম্মান ও হেনস্তাও করেনি তিনি।
সখিপুর বিদ্যুৎ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর তালুকদার ঠিকাদার অন্তরের তদবিরে প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের বদলি করার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘অন্তরকে আলাদা সুবিধা দেওয়ার কথা সঠিক নয়। ঠিকাদার পরিচয়ধারী কিছু লোক সুবিধা না পেয়ে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
অন্তরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব জানেন টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ছেলেটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আমি শুনেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’