আধুনিক কালের কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি, রোমান্টিক কবি। প্রকৃতির নির্জন ও প্রচ্ছন্ন রূপের মধ্যে জীবনানন্দ তাঁর রূপকথা সৃষ্টি করেছেন। বাংলার রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন, ভুলে থাকতে চেয়েছেন যাপিত জীবনের দগ্ধ যন্ত্রণা। প্রকৃতির সজীবতার মাঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করেছেন তিনি।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় জগতের পরিচিত পশুপাখি, নারী, আলো, বাতাস, গাছগাছালি সব কিছু নিয়ে এমন মায়ার চিত্রকলা (ছবি বা ইমেজ) তিনি অঙ্কণ করেছেন যা অতুলনীয়। যেমন : “কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা।”
কিংবা, নারীর সৌন্দর্যের ছবি একেঁছেন তিনি এভাবে
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা / মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য”
জীবন ক্ষয়শীল ও পরিবর্তনশীল, মৃত্যুতে সবকিছুরই সমাপ্তি, এই আদিম বেদনা জীবনানন্দের কাব্যের ভিত্তি। তিনি বলেন,
“মরনের পরপারে বড় অন্ধকার / এই সব আলো প্রেম নির্জনার মতো।”
এই জীবন যখন ক্ষয় হয়ে যায়, শিশিরের শব্দের মতো নিরবে যখন বার্ধক্য আসে, তখন মানুষের নতুন করে পাওয়া বা হারানোর কিছু থাকে না, তখন সে একমাত্র প্রেমিকার কাছে বসে গভীর প্রশান্তি পায়। কবি বলেন, ” সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের লেনদেন / থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
বুদ্ধদেব বসুর মতে, “জীবনানন্দর কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো – একটি সুর, আর কিছু না। তাঁর জগৎ প্রায় সম্পূর্ণরূপে চোখে দেখার জগৎ। তাঁর কাব্য বর্ণনাবহুল, তাঁর বর্ণনা চিত্রবহুল, এবং তাঁর চিত্র বর্ণবহুল। বর্ণনাকে পাঠকের মনে পৌছিয়ে দেবার বাহন তাঁর উপমা। উপমা তাঁর কাব্যের কারুকার্য মাত্র নয়, উপমাতেই তাঁর কাব্য।”
তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্য পাঠ করেছেন, আত্মস্থ করেছেন পাশ্চাত্য দর্শন ও শিক্ষা। এরপর তিনি দেশজ ও বিদেশী শব্দের স্বচ্ছন্দ ও সংগত প্রয়োগে তৈরি করেছেন তাঁর নিজস্ব মায়ার জগৎ। সে জগত সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণ চেতনা দ্বারা নির্মিত। স্বতঃস্ফূর্ত, বিশুদ্ধ ও সহজ রচনাগুলো ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষ ও জীবন্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি। তাঁর জগত আধো আলোর, আধো ঘুমের মোহে, আবছায়ায়..
‘আমার মতন কেউ নাই আর’ – কবির এই স্বগতোক্তি আক্ষরিক অর্থে সত্য। তিনি স্বতন্ত্র, ‘সকল লোকের মধ্যে আলাদা’। তাঁর গান ‘উৎসবের’ বা ‘ব্যর্থতার’ নয় অর্থাৎ বিদ্রোহের, আলোড়নের নয় – তাঁর গান সমর্পণের, আত্মসমর্পণের, স্থিরতার।
মোঃ সাব্বির হোসেন
বাংলা বিভাগ, সরকারি বাঙলা কলেজ