জমিরউদ্দীন বিছানা ছেড়ে নেমে অন্ধকার হাতড়ে দরজা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। অমাবস্যা রাত। এখনো আকাশ ফর্সা হতে ঢের বাকি। সে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।ঘুম আসে না।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে।।জমিরউদ্দীন বিছানায় বসে ভাবতে থাকে, মানুষটা প্রতি রাইতে ক্যান অমন কইরা কান্দে?কি অইল হঠাৎ? কোনো অসুখ টসুখ বাধাইলো নাতো!কি জানি মাইয়া মাইনষের মন কখন কি অয় ওপরওয়ালাই জানে। ইয়া মাবুদ মাফ করো। মানুষ যখন খুব কষ্টে থাকে তখন দিনে রাইতে অমন কইরা কান্দে।কিন্তু রহিমার এত কষ্ট কীসের? আমি কি ওরে কোনোদিন গালমন্দ করছি?নাকি ভাতে কষ্ট দিছি?মানুষ খারাপ স্বপ্ন দ্যাখলেওতে অমন কইরা কান্দে না।শয়তানতো মাইয়া মানুষের পিছনেই লাইগ্যাই থাকে।দুই বছরে রহিমা বিবি কত বদলাইয়া গ্যাছে।প্রথম যেদিন রহিমারে ঘরে আনলাম লজ্জায় কারো সাথে কথা কইতো না। সবসময় বড় ঘোমটা দিয়া থাকতো।আর আমি তারে আড়চোখে দেখতাম।আমি ঘরে ঢুকলে পেছনের দরজা দিয়া বাইর হইয়া যাইতো।লোকজন কানাকানি করতো।মানুষ যেই দেখতো সেই কইতো জমিরউদ্দীনের বউয়ের মতো অমন রূপবতী বউ গেরামে আর একটাও নাই।মাঝে মাঝে মনে হইতো আমারে বোধহয় তার পছন্দ হয়নাই। একদিন রাইতে বেলা খাবার দিয়া কয় খাইয়ে নিলে ভালো হয়।
আমি কইলাম আইচ্ছা রহিমা আমারে কি তোমার ভালা লাগে নাই?রহিমা তখন দাঁত বাহির কইরা রাঙা হাসি দিয়া ঘোমটা টেনে পালালো।
রহিমা তুমি সত্যিই একখান খাঁটি সোনা।
দূর মসজিদে মোয়াজ্জিন ফজরের নামাজের আহবান জানাচ্ছে।জমিরউদ্দীনের ঘোর ভাঙলো।
সে কি! আমি আজানের সময় এইগুলা কি ভাবতেছি?তওবা তওবা আল্লাহ মাফ করো।
রহিমা, ও রহিমা উঠবা না?আজান হইয়া গ্যাছে।
-উম
-আরে উঠো না বেলা বাইড়া যাইতাছে কামে যাইতো হইবো।
রহিমা চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে পড়ে।গাল বেয়ে অশ্রু গড়ানোর দাগ রয়ে গ্যাছে।
-আইজ না গেলে অয় না?
-সংসার চলবো ক্যামনে?মায় কইছে পুরুষ মানুষ আলসেমি করলে ঘর লক্ষ্মীছাড়া অয়। কপালে দুঃখ নামে।
রহিমা গম্ভীরমুখে বলল-আইচ্ছা যাও।তারাতারি ফির্যা আইয়ো।
তোমারে একখান কথা কই রহিমা। মন দিয়া হুনো মাইয়া মানুষের রাইতে বেলা অমন কান্দন ভূত পেত্নির নজরে পড়ার লক্ষ্মণ। অমন কইরা কানবা না।কোনো রকম অসুবিধা হইলে আমারে কইবা।
রহিমা সুবোধ বালিকার মতো মাথা নেড়ে সায় দেয়।
কে বুঝবে তার দুঃখ?সমাজে সন্তানহীন নারীর যেন আজন্মই পাপ।
রহিমা প্রতিরাতে খোয়াব দেখে তার একটা ছেলে সন্তান হয়েছে।তাকে কাছে ডাকে আদর করতে চায়।কিন্তু ছেলেটা দৌড়ে পালায়।রহিমা তখন দুঃখে কষ্টে বালিশ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে।স্বামী জমিরউদ্দীন প্রশ্ন করলে কিছু বলে না। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোরের আলো ফুটছে সবে।পাখির কিচিরমিচিরে চারদিক মুখরিত। রহিমা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। ও ঘর থেকে শাশুড়ির হামান দিস্তার ঘটঘট শব্দ আসছে।গরুগুলো গোয়ালায় হাম্বা রবে ডাকছে।একদল ছোট ছেলে মেয়ে উঠানের চারপাশে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।রহিমা বারান্দার থাম ধরে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখছে।চোখে জল টলমল। এমন সময় পাশের বাড়ির এক বুড়ি এসে রহিমার শাশুড়ির সাথে গল্প জুড়ে দিলো।
-জমিরের মা বউতো একখান আনছিলা রাজলক্ষ্মী। অমন সুন্দরী সাড়া গেরামে নাই।তা ছেলেপুলে না হইলে অমন রূপের দাম কি?তার থিক্যা ভালো জমিররে আরেকখান নিক্যা দাও।
রহিমা বিবির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কথাটা বারবার ধ্বনিত হয়ে তার বুকের ভেতর তিরের মতো আঘাত হানতে লাগলো।কেউ যেন তার পোড়া মনে বিষ ঢেলে দিল।মুহূর্তেই একটা বিপর্যয়কারী ঘটনা ঘটল।রহিমা বারান্দা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যেতেই লোকজন ধরাধরি করে ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিলো।রহিমা ধীরে ধীরে চোখ মেলল। তার শান্ত চোখদুটো চারপাশ খুব নিখুঁতভাবে অবলোকন করছে।ঝকঝকে আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। বজ্রধ্বনি কানে বাজছে। পাখিগুলো ডানা ঝাপটে নীড়ে ফিরছে।জমিরউদ্দীন কোদাল কাস্তে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
-রহিমা বিবি, ও রহিমা বিবি ছাতাডা দ্যাও দেহি অইদিকটার কি অবস্থা।
রহিমার কোনো সাড়া নেই।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বৃষ্টি থেমে গেছে। মাঠের ধানগুলো দমকা বাতাসে নুইয়ে পড়েছে। জমির ছাতা মাথায় ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে আছে। থমথমে প্রাণবন্ত প্রকৃতির মাঝে সে তার ভাগ্যের অঙ্ক কষছে। কিছুতেই মিলছে না। বিধাতার লীলা কে বুঝবে? আবার গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। বৃষ্টি নামবে। জমির বাড়ি ফিরে এলো। উঠানে পা দিতেই কেমন শূন্যতা অনুভূত হলো। সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় ঘরের দাওয়ায় কি যেন জ্বলজ্বল করছে। জমিরউদ্দীন হাতে তুলে নেড়েচেড়ে দেখল। এ যে রহিমার নাকছাবি!এখানে কি করে এলো! মানুষের যখন চারপাশটা অন্ধকারে ঢেকে যায় তখন প্রকৃতিও তার প্রতি বিরূপ আচরণ করে।
জমির ধীর পায়ে অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়ল। চৌকির একপাশে কুপি জ্বলছে।
-রহিমা বিবি, রহিমা বিবি।এই দুর্যোগের রাইতে কই গেলা? নেই।কোথাও রহিমা বিবি নেই।রহিমা বিবির এ কেমন বাতুলতা? বলা নেই কওয়া নেই কোথায় যাবে সে! স্বামী সংসার ছাড়াতো তার আর কেউ নেই।জমিরের মনের মধ্যে তরঙ্গ ঝংকৃত হতে লাগল। রহিমার এ কেমন সান্ধ্যপ্রেম!
জমির প্রতিরাতেই কান্নার শব্দ পায়।