মাছ শিকার করতে আসা শিকারির হাত যখন পলোতে আটকে পড়া একেকটা মাছকে স্পর্শ করে, তখনই শুরু হয়ে যায় তুমুল হই-হুল্লোড়। আর মাছের আকার যদি হয় বেশ বড় , তাহলে হই -হুল্লোড় যায় আরো বেড়ে। শত শত মানুষের সম্মিলিত উদ্যাপন, এ যেন আবহমান গ্রামবাংলার চিরায়ত এক উৎসব।
আর শত বছর ধরে এই ঐতিহ্য বহন করে যাচ্ছে নরসিংদীর রায়পুরার উপজেলার পলাশতলীর খলিলাবাদ গ্রামের বিল।
প্রতিবছরের মতো এই বছর বিলে ৭ মার্চ সোমবার দিনভর ‘পলো বাওয়া’ উৎসব হয়েছে।
এ উৎসবে অংশ নিয়েছেন আশপাশের গ্রাম ও দূরদূরান্ত থেকে আসা হাজারখানেক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর। আয়োজকেরা বলছেন, বছরে একবার এই সময়ে বিলটিতে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তবে বিলে মাছের নড়াচড়া ও পানির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে এই মাছ ধরার উৎসব কখনো কখনো বছরে দুইবারও হয়।
আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার শখের মাছ শিকারিদের পলো বাওয়া উৎসবের খবর জানানো হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে।
নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকেই দলে দলে লোকজন হাজির হয়ে যায়। খলিলাবাদ বিলে পলো উৎসবে এবারও নরসিংদীর ছয় উপজেলা, গাজীপুরের কাপাসিয়া, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মাছশিকারিরা অংশ নিয়েছেন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, খলিলাবাদ গ্রামের বিলে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই উৎসব হয়। তবে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তবু প্রতিবছর দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ এখানে পলো উৎসবে অংশ নেন। অন্যদিকে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের অনেক পরিবারের মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে নাইয়র আসেন। এ সময় গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
পলো বাওয়া উৎসবে গিয়ে চোখে পড়ে , বিলের দুই পাড়ে শৌখিন মাছ শিকারিদের সঙ্গে উৎসুক দর্শকদের ভিড়।
সবাই একসঙ্গে লাইন ধরে লুঙ্গি আঁটসাঁট করে বেঁধে নান্দনিক ছন্দে পলো দিয়ে মাছ ধরছেন। সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়া অনেকের মাথায় গামছা বাঁধা। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছের মধ্যে শোল, বোয়াল, চিতল, নলা ইত্যাদি মাছ তাঁদের পলোতে আটকা পড়ছে। পলোর ভেতরে কোনো মাছ আটকে পড়েছে বুঝতে পারলেই ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখছেন, যাতে নিচের দিকে কোনো ফাঁক না থাকে। এরপর ওপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরছেন আটকে পড়া মাছ। উৎসবে অংশ নেওয়া অনেকেই এসব মাছ ধরতে পেরে আনন্দে আত্মহারা। আবার কেউ কেউ কোনো মাছই পাচ্ছেন না।
মাছশিকারিরা বলছেন, প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতে দু-একটি পলো থাকা চিরায়ত গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ছিল। মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগি ধরে রাখার জন্যও ব্যবহার করা হতো পলো। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে পলো দিয়ে মাছ ধরা। এই মৌসুমে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ পানিতে গিয়ে জমে আছে। তাই এই সময়েই পলো নিয়ে মাছ ধরা হয়।
মো. আরমান মিয়া নামের একজন মাছ শিকারী বলেন, পলো নিয়ে মাছ ধরার এই উৎসবে তিনি এসেছেন গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে। প্রায় প্রতিবছরই এখানে আসেন। মাছ পাওয়া না-পাওয়া কোনো বিষয় না। সবাই মিলে উদ্যাপন, হই-হুল্লোড়, এটাই অনেক আনন্দের।
শিবপুর থেকে আসা ইয়াসিন নামের একজন বলেন, একটা বড় সাইজের শোল মাছ তাঁর পলোতে ধরা পড়েছে। এ এক অন্য রকম আনন্দ। শিপন মিয়া নামের আরেকজন বলেন, তিনি একটি বোয়াল পেয়েছেন। মাছটি কত বড়, এটা বড় কথা নয়। অনেকে বিক্রি করে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু লাখ টাকা দিলেও বিক্রি করবেন না বলে জানালেন। মাছটি বাড়িতে নিয়ে যাবেন।
আয়োজকদের একজন শবিকুল ইসলাম বলেন, এই বিলে এই পলো বাওয়া উৎসব কবে শুরু হয়েছিল, তা স্থানীয় ব্যক্তিদের কেউ জানেন না। ছোটবেলা থেকে তাঁরা নিজে এই উৎসব দেখছেন, বাপ-দাদার মুখেও এই উৎসবের গল্প শুনেছেন। দিন-তারিখ ঠিক হওয়ার পর লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই বিলে মাছ ধরতে চলে এসেছেন। এখানে মাছ ধরতে আসা কারও কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে পলাশতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ভূঞা বলেন, প্রতিবছরই এই বিলে উৎসবমুখর পরিবেশে পলো বাওয়া উৎসব হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও সাতসকালেই পলো হাতে ছোট-বড় প্রায় হাজারখানেক মানুষ এই বিলে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। নতুন প্রজন্মের জন্য এসব ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে।
নাজমুল হাসান, সাংবাদিক