দুপুর অবধি ই-পেপার খুঁজলাম। বিকেলে সাবেক এক সহকর্মীর ফোন। ভাইয়া, কেমন লাগলো নতুন দৈনিক? বললাম, এখন অবধি হাতে পাইনি। সে বললো, কিনে পড়েছি ভাইয়া। গতানুগতিক লেগেছে। বললাম, বিভাগীয় পাতাগুলো? বললো, মফস্বল পাতা নেই; দু’পাতা ‘অর্থকড়ি’। তবে নতুন কিছু পেলাম না…! শুনে কৌতুহল আরও বাড়লো।
সন্ধ্যার পর হাতে পেলাম পত্রিকাটি। প্রথমেই সম্পাদকের কথা ‘আবার কেন নতুন দৈনিক’ পড়লাম। চোখ আটকালো দুটো লাইনে, ‘সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক একটি আধুনিক পত্রিকা আমরা পাঠকদের উপহার দিতে ইচ্ছুক। যেটি জ্ঞানভিত্তিক সময়োপযোগী সমাজ গঠনে সহায়ক হবে’।
ভীষণ অবাক লাগলো, এখন তো সম্পাদকেরা শুধু রাজনীতিতে বিশেষজ্ঞ আর বেশিরভাগ বিজ্ঞানে মূর্খ। তারা ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ বুঝবেন কী করে? এক ইঞ্চিও খরচ করেন না বিজ্ঞানে। অথচ টকশোতে ‘ডিজিটাল’, ‘স্মার্ট’, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ নিয়ে ফেনা তোলেন। আর মগজভর্তি পচা রাজনীতির হিংসা-ঘৃণাময় বিভাজনকে অনবরত প্রমোট করে চলেন। সমাজকে মূর্খ, বিচ্ছিন্ন হিসেবে গড়ে তুলতেও জুড়ি নেই। মাত্র এক মিনিটের জন্য ঢাকাকে শব্দদূষণমুক্ত করতে যেটুকু ধৈর্য্য, জনসচেতনতা দরকার কয়েক দশকে সেটুকুর জোগানও তো দিতে পারেনি আমাদের প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো।
নতুন সব পত্রিকার গদবাঁধা-ছকবাঁধা ফাঁপা অঙ্গীকারের বিপরীতে ‘খবরের কাগজ’ এর সম্পাদকের জ্ঞানভিত্তিক সময়োপযোগী সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি অসাধারণ আধুনিক মনস্কতা। সুসাংবাদিকতার দৃঢ় অঙ্গীকারে সম্পাদক বলেছেন, ‘প্রভাবশালীদের চোখরাঙানির ভয়ে আমরা বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকব না’। শিল্পী নিয়াজ চৌধুরী তুলির আঁকা কার্টুনও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অবশ্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে চাউর করা হয়েছে (প্রেসে করা লাইভে ভি-চিহ্ন প্রদর্শনসহ) তাতে উদ্বোধনী সংখ্যা ঘিরে প্রত্যাশার চাপ বেশি ছিল। বাস্তবতায়, বিজ্ঞাপনের দিকে যতটা নজর ছিল, সম্পাদকের অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে ততটা চমক রাখা হয়নি। লিডের উপস্থাপনা দিয়ে অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ বা আনকোড়া আইডিয়ার শূন্যতাকে ঢাকা যায়নি। বিশেষ পাতার অর্থনীতিবিষয়ক লেখাগুলোর ফোকাস সময়োপযোগী।
‘যুক্তিতর্ক’ পাতায় নিজেদের ঢাক পিটিয়ে প্রত্যাশার বোঝা ভারী করার চেয়ে পশ্চিম, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমের সঙ্গে দেশীয় সংবাদমাধ্যমের তুলনা কিংবা আগামীর প্রিন্টমিডিয়ার রূপরেখায় ইঙ্গিত করা যেত। ‘প্রসব বেদনাকালীন’ দেড় দু’মাস কম সময় নয়। অন্তত চমকে দেয়া একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি হতে পারতো। শীর্ষ জনপ্রিয় গণমাধ্যমেরও নজর পড়েনি, দেশে এমন বিষয় বা খাত এখনও ভুরি ভুরি রয়েছে। সেগুলো প্রস্তুতিপর্বের আইডিয়ায় আনা যেত।
ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হওয়া দেশীয় গণমাধ্যম থেকে সাংবাদিকতা হারিয়েই গেছে। সংবাদকর্মীদের সবাই এখন চাকরিজীবী। বিগবাজেটের পত্রিকা মানেই শত শত বেকারের কর্মসংস্থান। নিউজ নিয়ে বিশ্লেষণ বা গবেষণার সময় কোথায়? রিপোর্ট যত লম্বা আর আয়তনে বড় হবে ততই তা এক্সক্লুসিভ! এমন বাস্তবতায় পত্রিকা জনপ্রিয়করণে সুসাংবাদিকতা পাহাড়সম চ্যালেঞ্জের। এর ওপর রাজনৈতিক ঘৃণা আর হিংসার ভিত্তিতে বিভাজিত কলুষিত সমাজকে আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক হিসেবে গড়ে তোলা আরও দুঃসাধ্য। বিশেষত যেখানে দলদাস সংবাদমাধ্যমই পদে পদে বড় বাধা।
সুসাংবাদিকতার জন্য অতি জরুরি হলো আধুনিক, স্মার্ট, ইন্টিগ্রেটেড টিম’। এমন টিম নিয়ে নতুন দৈনিক ‘খবরের কাগজ’ জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে অব্যর্থভাবে এগিয়ে যাক। পচা-দুর্গন্ধযুক্ত রাজনীতির গতানুগতিক ন্যারেটিভ বর্জন করে তরুণদের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে রাজনীতির রূপরেখার সূত্রপাত ঘটাক। বিজ্ঞান ছাড়া প্রযুক্তি অন্ধ, তাই মৌল বিজ্ঞানের পাতা থাকুক, উন্নত রুচির সমাজ বিনির্মাণে ক্রমাগত ভূমিকা রাখুক, অভিজাতপাড়া থেকে গণমাধ্যম প্রান্তিকে ফিরুক- সেটাই প্রত্যাশা থাকবে।
নিয়ন মতিয়ুল
বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আনন্দবাজার