পশ্চিম আফ্রিকান পোশাক পরে বসে আছেন পাকিস্তানি গায়ক। গান শুরু হলো পাঞ্জাবি ভাষায়। অদ্ভুত এক সেট আর সেখানে বিভিন্ন ধারা ও ঘরানার মানুষের উপস্থিতি। কোক স্টুডিও পাকিস্তানের ‘পাসুরি’ এভাবেই শুরু হয় কিংবা এভাবে তাকে উপস্থাপন করা যায়। কথা আর সুরের মেলবন্ধন তো গানে থাকেই, কোক স্টুডিও সেখানে সুরের সঙ্গে সুর মেলাতে পারদর্শী। এবার তার সঙ্গে মিলেছে উপস্থাপনের নতুন কিছু অনুষঙ্গ। গানের কথা, সুর ও অন্যান্য সংযোজনের মাধ্যমে গানটি ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘পাসুরি’র গুণকীর্তন চলছে। করা হয়েছে কভার, হয়েছে নাচ ইত্যাদি। কিন্তু সেখানে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, গানটি আসলেই ভালো?

ফিউশনে কোক স্টুডিও যেভাবে কাজ করে তা অন্য কোথাও দেখা যায় না। এক যুগের বেশি সময় ধরে দর্শককে মাতিয়ে রাখছে এ আয়োজন। দর্শক মাতানোর সঙ্গে দিয়েছে মানসম্মত বহু গান। তবে এ বছর সেট ডিজাইন থেকে গানের ধরন, উপস্থাপন, সবকিছু নতুন করে সাজানো হয়েছে। সাধারণত ফোক ও সুফি ধারার গানের ফিউশন কোক স্টুডিও পাকিস্তানের বৈশিষ্ট্য হলেও এবার তুলনামূলক মৌলিক গান আনছে তারা। ২০১৭ সালে স্ট্রিংস চলে যাওয়ার পরের মৌসুমগুলো ভালো কাটেনি। মান নিয়ে কথা উঠেছিল। গত মৌসুমে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। এবারের মৌসুম নিয়েও শুরুতে দ্বিধা ছিল। কিন্তু সব হিসাব বদলে দিল ‘পাসুরি’। ভারতের এ সময়ের জনপ্রিয় কবি রূপী কউর গানটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘The words, the sound, the video, Ali Sethi, all of it makes me want to go and write a love poem.’
পাঞ্জাবি ‘পাসুরি’ শব্দটির বিভিন্ন রকম অর্থ হতে পারে। দ্বিধা, তাড়া এমনকি দ্রুততা অর্থেও ব্যবহূত হয়। আলি সেঠির গানে পাসুরি বলতে দ্বিধা কিংবা সংকটের কথাই এসেছে। একটা সময় যখন শিল্পীদের ওপর সীমান্ত পার করার নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, সেঠি তখন এ রকম একটি গান লেখার কথা ভাবেন। এক সাক্ষাত্কারে সেঠি জানান, গানটির পেছনে এক বছরের বেশি সময় দিয়েছেন। ফজল আব্বাসের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা গানটিতে শিল্পীর ভেতরের ক্ষোভকে শব্দে প্রকাশ করা হয়। ‘পাসুরি’ মূলত মানুষের মধ্যে থাকা শিল্পের প্রতি সমাজের নানা বিধিনিষেধ নিয়ে কথা বলে। গানের কথায় সরাসরি সেসব না এলেও রূপকের মাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিষয়গুলোর প্রকাশে বিভিন্ন প্রতীক—যেমন নাচ, মানুষের মুখ, ব্যক্তির ভিন্নতা—উপস্থাপন করা হয়েছে।

গান হিসেবে ‘পাসুরি’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক এর মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট। কম্পোজার জুলফি গানটিকে পাকিস্তানি ‘লোরি’র সঙ্গে মিলিয়ে উপস্থাপন করতে চাইলেন। এরপর সেখানে যুক্ত হয় আরো কিছু বিষয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, গানের কথাগুলো বিষণ্নতায় ভরা। কিন্তু গানে আনন্দঘন বা উৎসবের একটি সুর দেয়া হয়েছে। আলী সেঠি এ ধরনের কাজ আগেও করেছেন। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা থেকে করা ‘দিল কি খ্যায়ের’ গানটির উপস্থাপনাও এ ঘরানার। বিষাদকে আনন্দের সুরে প্রকাশের পাশাপাশি এখানে মানুষের ভিন্নতা দেখানো হয়েছে। মূলত পাসুরি এখানেই শৈল্পিক হয়ে ওঠে। আলী সেঠির পশ্চিম আফ্রিকান পোশাক, শেয় গিলের জিপসি সাজ এখানে ভৌগোলিক বা সাংস্কৃতিক-বৈচিত্র্য দেখায়। মিউজিক ভিডিওর সেটটি একটি বাড়ি এবং এর বিভিন্ন কুঠুরিতে থাকা ভিন্ন মানুষগুলো তাদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে। বাড়িটি এ সমাজের রূপক এবং পাসুরি মূলত মানুষের বৈচিত্র্যের প্রতি সমাজের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলে।
‘আগ লাভা মাজবুরি নু/ আনে যানে দি পাসুরি নু’ বলার মাধ্যমে মূলত দ্বিধা কাটিয়ে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছে। গানে প্রেম বা প্রিয়তম বলে যাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তাকে মানবসত্তা বললে ভুল হয় না। কেননা ‘আনা সি ওহ নেই আয়া’ বলে মূলত বোঝানো হচ্ছে যার পাশে দাঁড়ানোর কথা সে পাশে ছিল না। এসবের মাঝে শীমা কেরমানির নাচ আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সুরের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে কেরমানির সিম্বলিক পারফরম্যান্স থেকে সিরাইকি ঝুমর নাচের মাধ্যমে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে পুনরায় স্বীকৃতি দেয়া হয়। পুরো গানে থাকা বোহেমিয়া ফুটে ওঠে এ গানের সেটের মাধ্যমে। সুর, সেট, আলী সেঠির মোটিভেশনাল গায়কির বিপরীতে শেয় গিলের মিষ্টি কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠ এক অদ্ভুত প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সুরের মধ্যে এমন একটা জাদু আছে যে ছন্দটা গেড়ে বসে মগজে। অনেকে তাই বলেই ফেলেন, ‘গানটা এমন কিছু না।’ কিন্তু আদতে কথা, সুর, মানুষের মুখ, দেয়ালচিত্র থেকে শুরু করে ভিডিওর উপস্থাপনা মিলিয়ে পাসুরি একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প হয়ে উঠেছে।
মাহমুদুর রহমান